বয়স মাত্র ৩৮, কিন্তু মুখে ক্লান্তির ছাপ—এ যেন বছরের পর বছর সংসারের বোঝা বইতে বইতে ক্লান্ত এক নারী। মৌমিতা দাস, কলকাতার উপকণ্ঠে একটি ছোট্ট ভাড়া বাড়িতে স্বামী ও দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে নিম্ন-মধ্যবিত্ত জীবনে লড়াই করে যাচ্ছিলেন। স্বামী বেসরকারি একটি কোম্পানিতে ছোট চাকরি করতেন, কিন্তু করোনার পর ছাঁটাই হয়ে যান। সেই থেকে ঘরের বাজার চলত শুধু মৌমিতার হাতে-তোলা সেলাই আর রান্নার অর্ডারের টুকটাক ইনকামে।
একদিন পাড়ার বিউটিশিয়ান “শিপ্রাদি”—যার সাথে মৌমিতার আলাপ ছিল বহুদিনের—বলল, ” মৌমিতা, তুমি এত সুন্দরী, এত কষ্ট করে ছেঁচে ছেঁচে টাকা কামাতে হবে না। আমি একটা জায়গা চিনি, সেখানে গেলে এক রাতেই তোমার মাসখানেকের বাজার খরচ উঠে যাবে।” প্রথমে চমকে উঠেছিল মৌমিতা। কিন্তু যখন টানা তিন মাস ধরে বিদ্যুতের বিল জমে, ছেলেটার স্কুল ফি দিতে না পেরে হেডমাস্টারের ফোন আসে, তখন শিপ্রাদির কথাগুলো কানে গেঁথে যায়।
প্রথম দিনটা ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। শিপ্রাদি তাকে নিয়ে গেল একটি হোটেলে—এক “পার্টি”র নাম করে। সেখানে এক ৫০ ছুঁই ছুঁই বাবু, দামি সিগারেট হাতে, তাকে বলল, “শুধু একটু গল্প করো, আর কিছু না।” কিন্তু রাতের শেষে মৌমিতা বুঝে গেল এ কেবল শুরু—এই গল্পে আর শুধুই গল্প নেই।
তারপর ধীরে ধীরে পালটে যেতে থাকে সে। শিপ্রাদি তাকে শেখাতে শুরু করল ‘ক্লায়েন্ট হ্যান্ডেলিং’, মেকআপ, পারফিউমের ব্যবহার, কীভাবে ফোনে কথা বলতে হয়। নিজের নামও বদলে নিল—“মায়া”। প্রথম দিকের আতঙ্কটা গা-সওয়া হয়ে গেল, তার জায়গায় এল কৃত্রিম আত্মবিশ্বাস।
মায়ার জীবনে টাকা আসতে লাগল। নতুন ফ্রিজ, ছেলের জন্য স্মার্টফোন, স্কুলের বকেয়া মিটে গেল। কিন্তু স্বামীর চোখে মায়ার পরিবর্তন ধরা পড়ল—নতুন শাড়ি, দামী ক্রীম, মাঝেমধ্যে রাতে না ফেরা। একদিন ঝগড়া চরমে উঠল। মৌমিতা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তোমার চাকরি চলে যাওয়ার পর আমি না থাকলে বাচ্চাগুলো না খেয়ে মরত!”
এভাবেই এক সহজ-সরল গৃহবধূ মৌমিতা থেকে জন্ম নিল “মায়া”—এক পেশাদার কল গার্ল, যার মুখে হাসি, চোখে সাজ, কিন্তু ভিতরে জমে থাকা কান্না কেউ শোনে না।
তারিখ: ১লা ফেব্রুয়ারি, ২০২২
আজ আমি একটা অন্য জীবনে প্রথম পা রাখলাম।
শিপ্রাদি সকালে ফোন করে বলেছিল, “রেডি থেকো। সন্ধ্যে ছ’টার সময় পিক করতে আসব। খুব ভালো লোক, এক রাতেই অনেক কিছু বদলে যাবে।” আমি কিছু বলিনি, শুধু মাথা নেড়েছিলাম। ভেতরে অদ্ভুত একটা শূন্যতা কাজ করছিল।
সন্ধ্যাবেলা যখন মুকুন্দপুরের একটা ছোট হোটেলে ঢুকলাম, বুকের ধুকপুকুনি এত জোরে হচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল, পাশের লোকটাও শুনে ফেলবে। শিপ্রাদি বলল, “চিন্তা কোরো না। কিছুই করতে হবে না, শুধু গল্প করো। হাসিখুশি থেকো। উনি একটু একা থাকেন, তোমার মতো কারো সঙ্গ চায়।”
ঘরে ঢুকে দেখলাম, একটা মাঝবয়সী ভদ্রলোক—বয়স পঁচিশ-ত্রিশ বছরের উপরে হবে, মাথায় চুল কমে এসেছে, একটা মৃদু সুগন্ধি পারফিউম ছড়িয়ে আছে ঘরে। প্রথমে চেয়ারে বসে শুধু তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। আমিও ভয়ে গুটিসুটি হয়ে বসেছিলাম।
তিনি হেসে বললেন, “তোমার নাম কী?”
আমি গলা শুকনো গলায় বললাম, “মৌমিতা… মানে মায়া।”
এক কাপ চা আনানো হল। আমি কাপটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। উনি বললেন, “আমি মুম্বই থাকি। বছরে দু’বার কলকাতা আসি। পরিবারের থেকে আলাদা থাকি। খুব নিঃসঙ্গ লাগে।”
আমি শুধু “হুম” বললাম। আর কিছু বলার সাহস হচ্ছিল না।
তারপর উনি হাত বাড়িয়ে বললেন, “ভয় পেয়ো না। আমি জোর করবো না কিছু।”
আমি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকালাম। সেই চোখে কামনা ছিল না, বরং ছিল ক্লান্তি।
তিনি বললেন, “আমাকে শুধু একটু ছুঁয়ে থাকো। কেউ অনেক দিন স্পর্শ করে না।”
আমি চুপচাপ হাত রাখলাম তার হাতে। তার হাতটা গরম ছিল, শক্তও। আর কিছু হয়নি। কোনো জোর, কোনো বাধ্যবাধকতা নয়। শুধু কিছুক্ষণ আমরা একে অপরের পাশে বসে থাকলাম।
রাতটা সে রকমই কেটেছিল—শুধু নিঃশব্দ গল্প, মাঝেমধ্যে চোখে চোখ পড়া, মাঝে একবার উনি আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আমি ঠায় বসে ছিলাম, জানলার বাইরে তাকিয়ে—জানালার ওপারেই ছিল আলো ঝলমলে শহর, আর জানলার ভেতরে আমি, মৌমিতা—নাকি মায়া, জানি না।
ভোর বেলা বেরিয়ে আসার সময় একটা খামে করে টাকা দিলেন। অনেক টাকা। শিপ্রাদি বলল, “তোমার কাজ পছন্দ হয়েছে। ভদ্রলোক আবার চাইবে।”
তারিখ: ১২ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২
আজ দ্বিতীয়বার… এবার আগের মতো নরম ছিল না কিছুই।আজ আমার ভেতরে কিছু ভেঙে গেল, আবার কিছু গড়ে উঠল।
শিপ্রাদি আগেই বলে দিয়েছিল, “এই লোকটা একটু রাফ, অভ্যস্ত মেয়ে চায়। তুমি যদি আজ একটু ‘অ্যাক্ট’ করতে পারো, তাহলে দামি ক্লায়েন্টদের তালিকায় ঢুকে যাবে। তুমি তো এখন মায়া, না?”
আমি হেসে বলেছিলাম, “হ্যাঁ, আমি মায়া।” অথচ হাসির আড়ালে গিলে ফেলেছিলাম একটা গোটা মৌমিতাকে।
হোটেলটা আগেরটার থেকে ভালো। এসি ঘর, রুমে ঢুকেই নরম আলো আর এক বোতল স্কচ আমার সামনে রাখা। আমি সালোয়ার কামিজ পরে গিয়েছিলাম, শিপ্রাদি বলেছিল গ্ল্যামার দেখাতে হবে না—প্রকৃতিই অনেক।
ঘরে ঢুকতেই লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে শুধু বলল, “তুমি কি নতুন?”
আমি চোখ নামিয়ে মাথা নাড়লাম।
সে একটা ঠান্ডা হাসি হেসে বলল, “তাই তো ভাবছিলাম। নতুনদের শরীরে একধরনের ভয় মেশানো গন্ধ থাকে। আমি সেটা পছন্দ করি।”
সে ধীরে ধীরে আমার কাছে এগিয়ে এলো। তার চোখে একরকম শিকারির উন্মাদনা। সে আমার হাত ধরে বিছানার দিকে নিয়ে গেল—না জোর করে নয়, কিন্তু দৃঢ়তার সাথে।
আমি যেন বোঝার চেষ্টা করছিলাম, ঠিক কখন নিজেকে ছেড়ে দিলাম। হঠাৎ সে বলল, “অভিনয় করো না। তুমি এখন মায়া। পুরোনো নামটা মনে রাখলে চলবে না।”
তারপর যা হল, তা বর্ণনা করা যায় না।
সে আমার চুল টেনে ধরল, মুখে গরম নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, “কিছু বলতে নেই। শুধু অনুভব করো। তুমি এখন আমার।”
আমি নিজেকে শক্ত করলাম। ভেতরে কান্না চাপা দিলাম। শরীরটা জবাব দিচ্ছিল, কিন্তু মনটা খালি হয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে।
সে এক এক করে আমার সমস্ত কাপড় খুলে ফেলল—আস্তে না, ধীরে না—অপমানে।
আমি চোখ বন্ধ করেছিলাম, শুধু অনুভব করছিলাম—আমি এখন শুধু শরীর, একজন নামহীন মায়া।
সব শেষ হওয়ার পর সে শুধু একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, “তুমি শিখে যাবে, মায়া। এই লাইনে টিকতে গেলে শুধু শরীর নয়, মাথা দিয়ে খেলতে হয়।”
আমি ধীরে ধীরে শাড়ি ব্লাউজ সব পড়ছিলাম। আয়নায় তাকিয়ে দেখলাম—চোখ লাল, ঠোঁট ছিঁড়ে গেছে হালকা, কাঁধে নখের দাগ। কিন্তু আশ্চর্যভাবে কান্না আসছিল না। বরং মনে হচ্ছিল, এই আমিটাই বুঝি সত্যি!
ঘর ছেড়ে বেরোনোর সময় আমার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিল—শিপ্রাদি বলেছিল, আজকের রাতের দামটা বেশ ভালো হবে। সত্যিই তাই।
হোটেলের বাইরের বাতাসটা ঠান্ডা ছিল, কিন্তু আমার গা ঘেমে ভিজে যাচ্ছিল।
তারিখ: ২৬শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২
আজ তৃতীয়বার। এইবার আর কোনও অচেনা রোমাঞ্চ নেই।দুপুরে শিপ্রাদি বলল, “আজ একটু সিনিয়র ক্লায়েন্ট। বয়সে পঁয়তাল্লিশের উপর, তবে একটু ভয় দেখাতে ভালোবাসে। ভয় পেয়ে গেলে বেশি টাকা দেবে। কাঁদলে তো পুরস্কার পাবে!”শুধু বলেছিলাম, “কী পরব?”
সে হেসে বলল, “আজ একটু লাল শাড়ি পরো, সাথে কালো হাতকাটা ব্লাউস আর চুলটা খোলা রেখো। তুমি তো ‘ইনোসেন্ট ঘরের বউ’ টাইপ দেখতে, সেটা ওদের খুব প্রিয়।”
ট্যাক্সি করে যখন হোটেলের সামনে পৌঁছলাম, তখন রাত প্রায় আটটা।
ঘর নম্বর ২০৪। দরজার সামনে পৌঁছে হাত কাঁপছিল।দরজা খুলল একজন মোটা, মাথায় চুল কম, সাদা শার্টের বোতাম খোলা—চোখে একধরনের খিদে।সে আমার দিকে একবার ভালো করে তাকিয়ে বলল,
– “তুই তো একেবারে বউমা টাইপ। ভীষণ টান ধরে রে তোদের দিকে।”
আমি একটা কৃত্রিম হাসি হেসে ঘরে ঢুকলাম।
ঘরটা বড়, এসি চলছে। সেন্ট ছড়ানো। একটা সেন্টের ঘ্রাণ মিশে আছে সিগারেট আর হুইস্কির গন্ধে।
সে আমার কাঁধে হাত রাখল। ঠান্ডা হাত।
– “চুপচাপ বসে থেকো না। এসো, আমার পাশে বসো। গল্প করি। আজ মন ভালো নেই।”
আমি ওর পাশে বসলাম। তার চোখ দুটো আমার বুকের ওপর আটকে আছে। সে আমার শাড়ির আঁচল সরিয়ে দিল,
– “তুমি কি জানো, এই ঘরের আলো তোমার গায়ে পড়লে তুমি যেন রক্তে রাঙা একটা ফুল হয়ে যাও।”
আমি চুপ। মাথা নিচু। সে আমার থুতনিতে আঙুল দিয়ে মুখটা তুলে ধরল,
– “ভয় পাচ্ছো?”
আমি মাথা নাড়ালাম—জানি না, হ্যাঁ না।
সে হঠাৎ একটা বিড়ির মতো হেসে বলল,
– “ভয় ভালো, প্রথমে একটু ভয় দেখাই, পরে তুমি খুঁজে পাবে স্বর্গ।”
তারপর শুরু হল আসল খেলা।
সে আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। আমার গলায় মুখ রাখল, গালে কামড় বসাল—ব্যথা লাগছিল।
তার হাত আমার ব্লাউজের হুক খুলছিল, আর চোখে ছিল এক ধরনের হিংস্রতা।
– “চিৎকার করো না। আমি জানি, তোরা চিৎকার করলেই বেশি টাকা পাস। কিন্তু আমি চাই, তুই স্বার্থ নিয়ে চুপ থাকিস।”
আমি মুখে হাত চেপে ধরেছিলাম, কারণ সত্যিই ব্যথা লাগছিল। সে কাঁধে দাঁত বসিয়েছিল—সেটা অভিনয় ছিল না।
সারা শরীরটা যেন অসাড় হয়ে যাচ্ছিল। মাথার ভিতর ঝড় বইছিল, কিন্তু বাইরে আমি একটা নিঃশব্দ পুতুল।
সে ঘুমিয়ে পড়ার আগে বলল,
– “তুই আবার আসবি। তোকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। তোর মতো নারীর গন্ধে পুরুষ বশ হয়, জানিস?”
আমি স্নান না করেই বেরিয়ে এলাম। গায়ে তখনো তার হাতের দাগ।
হোটেলের লিফটে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজের মুখটা দেখছিলাম—একটা ফাঁকা চোখ, একটা হাসিহীন ঠোঁট।
মনে হচ্ছিল, আমি একটা দাসী, যার দামে টান পড়েছে, কিন্তু সে হাসতে জানে না আর।
ঘর ছাড়ার আগে সে ১০ হাজার টাকা হাতে ধরিয়ে বলল, “আরেকদিন আসবে তো? তোমার মধ্যে কিছু আছে, যা অন্যদের নেই।”
ফিরে এসে দেখলাম, ছেলে হোমওয়ার্ক করছে। স্বামী বাথরুমে। আমি কিচেনে গেলাম ভাত বসাতে। গ্যাসের আগুনে মুখটা একটু জ্বলে উঠল।
হঠাৎ মনে হল, এক জীবনে আমি দুটো মানুষ—একজন রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে থাকা মৌমিতা, আর একজন হোটেলের বিছানায় শুয়ে থাকা মায়া।
আমি কি আসলে বেঁচে আছি, নাকি প্রতিদিন একটু একটু করে মরছি?
তারিখ: ৮ মার্চ, ২০২২
এখন আমি ‘মায়া’ নামেই পরিচিত অনেকের মধ্যে।
শিপ্রাদি বলল,
– “তোর চাহিদা এখন আলাদা। সেজেগুজে মিষ্টি গলার মধ্যে এমন কিছু আছে, যেটা ওদের পাগল করে দেয়।”
আমি হেসে বলি, “ওরা পাগল হয় আমার গলার জন্য না, ওদের স্ত্রীরা হয়তো কথা শোনে না, তাই…”
সত্যি কথা বলতে কি, এখন দুদিন বাদেই ‘প্রোগ্রাম’ থাকে।
আমি বেছে নিয়েছি দুপুরের সময়—যখন ছেলেটা স্কুলে, স্বামী অফিসে, পাড়া ঘুমিয়ে থাকে।
বিকেল হতেই আমি আবার সংসারিনী—হাতভর্তি শাঁখা, কাপড়ে আলু-পটলের গন্ধ।
কিন্তু দুদিন আগে এক অভিজ্ঞতা আমাকে ভেতরে কাঁপিয়ে দিয়েছে।
দক্ষিণ কলকাতার একটি অভিজাত ক্লায়েন্ট – বিক্রম সরকার।
চল্লিশ পেরোনো, নিজের ভাষায় ‘বিজনেসম্যান’—মনে হল একজন চালাক ধূর্ত পুরুষ।
সেই দুপুরে একটি ফ্ল্যাটে ডাকা হয় আমাকে, শিপ্রাদি বলেছিল,
– “ভদ্রলোক একটু পার্টি মুডে থাকে, একটু মদ টদ খায়। মানিয়ে নিস।”
আমি গোল্ডেন কালারের শাড়িতে সাজলাম, হালকা গ্লসি মেকআপ, ছোট টিপ, পারফিউম ছুঁইয়ে নিলাম।
দরজা খুলতেই সে বলল,
– “ওয়াও! তুমি তো একেবারে হাইফাই বউ! ওয়েলকাম টু মাই লিটল প্যারাডাইস!”
ফ্ল্যাটটা বড়, সাজানো, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত।
বিক্রম সোজা দুটো গ্লাসে মদ ঢালল—‘রেড লেবেল’।
আমি একটু ইতস্তত করছিলাম।
সে বলল,
– “মায়া, আরে একটু খাও না, রিল্যাক্স করবে। আমি খারাপ কিছু করব না। বরং তোমাকে রাণীর মতো রাখব আজ।”
আমি এক চুমুক খেলাম, প্রথমে তীব্র গন্ধ, তারপর ধীরে গলা জ্বলে উঠল।
সে হাসল,
– “শুধু শরীর না, কখনও কখনও মদেও একটা জাদু থাকে। দেখবে, আজ তুমি নিজেকে হারিয়ে ফেলবে।”
খানিক পর আমার মাথা একটু হালকা লাগতে লাগল।
সে তখন আমার চুলে হাত বুলিয়ে বলল,
– “তোমার মতো মেয়েদের শুধু বিছানার জন্য নয়, তোমরা পুরুষদের একাকীত্বের নেশাও।”
সে আমার গাল ছুঁয়ে বলল,
– “আজ আমি চাই তুমি নিজে থেকে এগিয়ে আসো। আমি জোর করব না। তুমি যদি হাসো, আমি জিতব।”
আমি ওর চোখে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ—এক ধরণের এলোমেলো অনুভূতি হচ্ছিল, নেশা, লজ্জা, অস্বস্তি সব একসাথে।
অবশেষে ওর কাঁধে মাথা রাখলাম।
সে হেসে বলল,
– “সেটাই তো চাই, একটা বউয়ের মতন তুমি আজ আমার হও।”
সেদিন রাতে আমি প্রথম বুঝলাম, নেশা আর শরীরের লেনদেন যখন মিশে যায়, তখন নিজেকে কোথাও হারিয়ে ফেলা যায়—একটা গহ্বরের মধ্যে পড়ে থাকা পুতুলের মতো।
ঘরে ফিরে আয়নাতে তাকিয়ে নিজের ঠোঁটের লিপস্টিক লেপ্টে যাওয়া দেখছিলাম, চোখে ছড়িয়ে থাকা কাজল।
নিজেকে চিনতে পারছিলাম না।
কিন্তু পরের দিনই আবার কল এলো।
– “মায়া, তোমার মতন মেয়েকে একটা সাপ্তাহিক কনট্রাক্টে নিতে চাই। তুমিই ঠিক করে দাও সময়, জায়গা, দাম।”
আমি ফোন নামিয়ে রাখলাম।
একটা কথা মাথায় ঘুরছিল—
“আমি কি এখন নিজের শরীরের ঠিকাদার? নাকি আমার শরীরই আমার মালিক?”
তারিখ: ১২ মার্চ, ২০২২
শিপ্রাদি বলল,
– “মায়া, আজ একটু আলাদা গেস্ট। খুব পাওয়ারফুল লোক, নাম সব্যসাচী মিত্র। মিডিয়ার লোক, রাজনীতির কানেকশন আছে, বড় বড় প্রোগ্রামে যায়। আজ তোর ওপর নির্ভর করছে সে আবার কল করবে কিনা।”
আমি হেসে বললাম,
– “বড়লোকদের মন বোঝা তো আমার কাজ হয়ে গেছে এখন, বলো কোথায় যেতে হবে?”
গাড়ি এসে আমাকে তুলে নিল। লোকেশনটা ছিল এক অভিজাত টাওয়ারের ২৫ তলা। ফ্ল্যাটের ভেতর ঢুকে আমি যেন একটু থমকে গেলাম—একটা নিঃশব্দ জগৎ, মার্বেল পাথরের ঠান্ডা মেঝে, সুগন্ধি বাতাস, আর ছায়ার মতো এক পুরুষ বসে আছে উইন্ডোর ধারে।
সব্যসাচী মিত্র।
সাদা লিনেন শার্ট, কালো প্যান্ট, হাতে চুরুট, চোখে কিছু একটা গভীর বিষাদ।
সে ঘুরে তাকিয়ে বলল,
– “তুমি মায়া? তুমি আসলে আমার গল্পের সেই চরিত্র, যাকে খুঁজছিলাম বহুদিন ধরে।”
আমি হালকা হেসে বললাম,
– “গল্পের চরিত্র হতে গেলে তো আগে চিত্রনাট্য পড়তে হয়, মিস্টার মিত্র।”
সে ঠোঁটের কোণে একফালি রহস্যময় হাসি দিল।
তারপর এল মদ। ব্ল্যাক লেবেলের গ্লাস আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল,
– “আজ শুধু শরীর নয়, আমি চাই তুমি ভেঙে পড়ো। নিজের সমস্ত মান, আবরণ, আত্মসম্মান ফেলে আমাকে তুমি যেন একটা পুতুলের মতো দাও—নিয়ন্ত্রণহীন, নির্ভরশীল, খালি। তুমি পারবে?”
আমি স্তব্ধ। কিছু না বলে শুধু এক ঢোক মদ খেলাম। বুঝে গিয়েছিলাম, আজ যা ঘটতে চলেছে, তা কেবল একটি শারীরিক সম্পর্ক নয়—এ এক মনস্তাত্ত্বিক শাসন।
ঘরের বাতি নিভল। তার হাত আমার চিবুকে, কানে গলা ছুঁয়ে বলল,
– “বউ হয়ে তো বাঁচলে। এখন একটু দাসী হও।”
আমি ধীরে ধীরে শাড়ির আঁচল খুলে দিলাম।
সে থামাল, বলল,
– “তাড়াহুড়ো করো না। তুমি যত আস্তে নিজেকে উন্মুক্ত করবে, আমি তত গভীর হবো।”
তারপর সে আমার হাঁটু মুড়ে বসতে বলল। বলল,
– “আমি যখন হুকুম দেব, তখন হাঁসবে। যখন বলব, তখন কাঁদবে। পারবে তো?”
আমি চুপচাপ মাথা নাড়লাম।
মদে গলা শুকনো, চোখে জলের রেখা।
কিন্তু সে আমাকে ক্রমশ ভাঙতে লাগল—এক একজন ক্লায়েন্ট চায় শরীর, কিন্তু সব্যসাচী চেয়েছিল আমার আত্মাকে ভেঙে নিজের দখলে আনতে।
তার বেডরুমে ঢুকে, আমি নিজেকে পুরোপুরি ছেড়ে দিলাম।
সে আমাকে কখনও ঠেলে, কখনও টেনে, কখনও আদর করে আবার অপমান করে বলল—
– “তুমি শুধু আমার। আমার খেলনা, আমার থেরাপি। নিজের বিবাহিত জীবনের হতাশা তোমাতে ঢেলে শান্তি পাবো আমি।”
সেদিন রাতে প্রথম বুঝলাম, একজন পুরুষ চাইলে কিভাবে একজন নারীকে পুরোপুরি ভেতর থেকে ধ্বংস করতে পারে—আদরের নামে, প্রভাবের নামে, ভালোবাসার ভ্রান্ত প্রতিশ্রুতিতে।
শেষে সে আমাকে এক চেক দিল, চোখে চোখ রেখে বলল,
– “তুমি এখন থেকে সপ্তাহে একদিন শুধু আমার জন্য রিজার্ভ থাকবে। সেদিন অন্য কারো কাছে যাবে না। গেলে, আমি জানব।”
আমি মাথা নিচু করে বলেছিলাম,
– “আপনার পছন্দ হলে, আমি থাকব। না হলে, মুছে যাবো। আমি শিডিউল চেক করে জানাচ্ছি।”
আগামীকাল এর শেষ পর্ব …