ফুলের নামে নাম পর্ব ১

অ্যাকাডেমির সেকেন্ড ইয়ারের পর একটা লম্বা ছুটি দেয়। সেই ছুটিতে বাড়ি ফিরলাম। ফেরার পর সবার আগে মুখোমুখি হলাম মা বাবার হাড়িমুখের। ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে আমার অ্যাকাডেমিতে জয়েন করায় সবাই বিরক্ত। খরচ দেওয়া বন্ধ ছিল কিছুদিন। তবে খুব একটা সমস্যা হয়নি। অ্যাকাডেমি থেকে মাসিক স্টাইপেন্ড যা দেওয়া হত তা দিয়ে একটু কষ্ট করলেই মাস টানা যায়। কোর্স শেষ হলেই সরকারি চাকরি। তবুও তাদের খুশি করা দুঃসাধ্য।

বাড়ি ফেরার পর জানতে পারলাম, মা বাবা দুজনেই ইন্ডিয়া যাবে ডাক্তার দেখাতে। আমার একমাস একাই থাকতে হবে। মনে মনে একটু বিরক্তই হলাম৷ এর চেয়ে অ্যাকাডেমির ডরমিটরিতে থাকাই আমার জন্য ভাল ছিল। তিনবেলা বিস্বাদ খাবার হলেও তো জুটত। (কোন অ্যাকাডেমি কি সমাচার বলা যাবে না। নিষেধ আছে।)

যাই হোক। একদিন বিকালে দরজায় টোকা পড়ল। দরজা খুলে একটা ধাক্কার মত খেলাম। বাইরে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ সুন্দরী, ফর্সা গায়ের রঙ, রেশমের মত ঢেউ খেলানো চুল নেমে গেছে কোমর পর্যন্ত। শীতের দিন হওয়ায় একটা শাল গায়ে। দোহারা গড়ণের শরীর। তবে মোটা নয়৷ স্বাস্থ্য ভাল। সবচেয়ে বেশী আকর্ষণীয় তার চোখ দুটো। বৈদূর্যমণির মত অন্তর্ভেদী দৃষ্টি ওই দুই চোখে। মনে হয় যেন ছিড়েখুড়ে দিচ্ছে। এমন ভয়ংকর সুন্দর চোখ সচরাচর দেখা যায় না৷ আমাকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটা নিজেই বলল, “আন্টি আছে?”
“ওহ, হ্যা। আসেন ভেতরে আসেন।”
“না। ভেতরে যাব না। একটু দরকার ছিল। আন্টিকে ডেকে দেন।”

আমি মা কে ডেকে নিয়ে এলাম।
মা আসলে তাকে কি যেন বলে চলে গেল মেয়েটা৷
মেয়েটা চলে যাবার পর বেশ অনাগ্রহের ভাব দেখিয়েই মাকে প্রশ্ন করলাম, “কে?”
“নিচতলার ভাড়াটিয়া সামাদের বউ।”
“সামাদ মিয়া বিয়ে করল কবে?”
“বেশিদিন হয় নাই।”

আমি আর কিছু বললাম না। দুইদিন পর মা বাবা চলে গেল। বাসায় একদম একা। করার কিছুই নেই। সারাদিন ঝিমাই। বাবার বদলির চাকরি ছিল। এখানে থিতু হবার আগে এত জায়গা ঘুরেছি যে খুব বেশি বন্ধু বানানোর সুযোগটা হয়ে ওঠেনি কখনোই। টুকটাক যারা আছে তারা কেউ শহরে নেই।

একদিন ঘুম ভাঙল বেশ সকাল সকাল। বাইরে কুয়াশা। একটা ডিম আর পরোটা ভেজে খেতে খেতে হালকা রোদ উঠল। ভাবলাম ছাদ থেকে ঘুরে আসি। একটা সিগারেটও খাওয়া যাবে ছাদে হাটতে হাটতে।

আমি ছাদে যেতেই দেখি ছাদের বাগানের মাঝখানে সেই ভাড়াটিয়া, মানে সামাদ সাহেবের স্ত্রী একটা মোড়া আর চেয়ার নিয়ে বসে আছে রোদের মধ্যে। সামনে খাতা কলম। আমি যেতেই ঘুরে তাকাল।
আমি সৌজন্য দেখিয়ে একটু হাসলাম, “ভাবী, কেমন আছেন?”
“ভাল,” ভাবীও পালটা হাসল। “আপনি ভাল আছেন?”
“জ্বি।”

আমি উসখুশ করতে শুরু করলাম। এইখানে সিগারেট খাব কিভাবে? আমি ছাদে পায়চারি করতে শুরু করলাম। করার মত কিছু পাচ্ছি না। হাঁটতে হাঁটতে তার কাছাকাছি চলে গেলাম। সামনে একটা চাকরির পরীক্ষার বই। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। একটা অংক নিয়ে মোটামুটি যুদ্ধ করছে সে। চাকরির পরীক্ষার বই। তার মানে অন্তত আমার দুই তিন বছরের সিনিয়র। অংকটা এখান থেকে দেখতে পাচ্ছি৷ আহামরি কিছু নয়। কিন্তু একটু কায়দা আছে। মেয়েটা সেই কায়দাটাই ধরতে পারছে না৷

গর্ব করে বলছি না, তবে অংকে আমি বেশ ভাল। অনেকসময় শুধু ডাক পড়েই বলে দিতে পারি উত্তর কি হবে। শোঅফ করার সুযোগটা ছাড়তে ইচ্ছা করল না৷ আমি মনে মনে হিসাব করে বলে ফেললাম, “৭২৩৪ টাকা ৬৭ পয়সা।”
ভাবী সাথে সাথে মুখ তুলে তাকাল আমার দিকে।

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “সরি। অংকটা। উত্তর হবে ৭২৩৪ টাকা ৬৭ পয়সা।”
“আপনি একবার দেখেই বলে দিলেন?” তার কন্ঠে স্পষ্ট অবিশ্বাস।
“উত্তর মিলিয়ে দেখেন,” আমি অন্যদিকে তাকিয়ে উদাস গলায় বললাম।
ভাবী মিলিয়ে দেখল। আমি তো জানিই যে উত্তর ঠিক আছে।
অবাক গলায় বলল, “দেখেই কিভাবে বললেন?”
“মনে মনে হিসাব করলাম।”
“যাহ, মনে মনে হিসাব করে অংক হয়?”
“হইল তো।”
“আচ্ছা এইটার উত্তর বলেন। তাইলে বুঝব।” বলে আরেকটা ডাকের ওপর আঙুল দেখাল সে।

আমি সামান্য ঝুকে এলাম উনার ঘাড়ের ওপর। হালকা একটা ঘ্রাণ নাকে এল কোল্ড ক্রিমের। মাথা ঝিমঝিম করে উঠল সাথে সাথে। অংকটার ডাকটা একবার পড়লাম। এই অংকটাও আহামরি কিছু না। পিতা পুত্রের বয়স অংকের মতই খানিকটা। একটু চোখ বন্ধ করে হিসাব করতেই পেয়ে গেলাম। সোজা হয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, “পিতার বয়স ৫৯। পুত্রের বয়স ৩০।”

এবার সত্যিই অবাক হলেন ভাবী। “ইশ আপনার তো দারুণ মাথা অংকে। আমি কেন যেন মেলাতেই পারি না।”
আমি ফট করে বলে ফেললাম, “আমি মাসখানেক আছি। আপনি চাইলে আপনাকে পড়াতে পারি।”
“আসলেই সময় দিবেন? আপনার অসুবিধা হবে না তো?”
“অসুবিধা আর কি। আপনাকে পড়াইলেই বরং আমার সময় কাটবে।”

ভাবী খুশি হয়ে গেল। তারপর আলাপে আলাপে জানলাম ভাবীর নাম শিউলি। সামাদ সাহেবের গ্রামেই বাড়ি। এই বছরই কলেজ থেকে অনার্স পাশ করে এখন সরকারি চাকরির চেষ্টা করছে।
আমি বললাম, “আমি তো মাত্র সেকেন্ড ইয়ার, আমাকে তুমি করেই বইলেন।”
“আচ্ছা বলব।”
সেই থেকে শুরু হল।

প্রতিদিন সকালে সামাদ সাহেব অফিসে চলে যাবার পর ভাবী আর আমি ছাদে যাই। অংক করাই। নানা বিষয়ে আলাপ করি। আলাপ করতে করতে ফ্রি হয়ে গেলাম অনেকটাই। সব বিষয়েই আলাপ শুরু হল। একদিন ভাবী বলল, “তোমার গার্লফ্রেন্ড নাই?”
“আছে, আবার নাইও।”
“মানে?” অবাক হল শিউলি ভাবী।
“মানে আমরা একজন আরেকজনকে পছন্দ করি। কিন্তু প্রেম করি না।”
“কইরা ফেলো,” ভাবী পরামর্শ দেয়।
“আরে ধুর,” আমি হাত নেড়ে উড়িয়ে দেই। কমিটমেন্ট আমার ভাল লাগে না।

আলাপ চলতে থাকে। পরেরদিন ভাবী গোসল করে এসেছে। আমি সকালে গোসল করা নিয়ে একটু দুষ্টামি করতেই শিউলি ভাবী লজ্জায় লাল। একদিন সকালে হাটতে বের হয়েছিলাম। বাড়ি ফিরলাম কোচরভর্তি শিশিরমাখা শিউলিফুল নিয়ে৷ ভাবীকে ফুলগুলো দিতেই সে ভারী খুশি হল।

এত বাড়াবাড়ি উচ্ছ্বাস চোখে লাগার মতই। আমি প্রশ্ন করে ফেললাম, “ক্যান? সামাদ ভাই তো নিশ্চয়ই আরও অনেক ফুল দেয়।”
ভাবী শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। “ওরে দিয়া এগুলা হয় না,” পরক্ষণেই আপন মনেই বিড়বিড় করে বলল, “পারে তো ওই একটা জিনিষই।”
আমি বললাম, “কি বললেন?”
“না, কিছু না।” ভাবী এড়িয়ে গেলেন। “আসো পড়ি।”
“কোন সমস্যা? আমার সাথে শেয়ার করতে পারেন।”
“আরে না, কি সমস্যা হবে।”
আমি আর কথা বাড়াই না। অংকের বইটা টেনে নেই৷

পরেরদিন থেকে শুরু হয় শৈত্যপ্রবাহ। ভয়াবহ শীত। বাইরে এক হাত দুরের জিনিষ কুয়াশায় দেখা যায় না এমন অবস্থা। লেপ মুড়ি দিয়ে একটা বই পড়ছি। এমন সময়ে দরজায় টোকা পড়ল।

আমি বিরক্ত হয়েই উঠে গিয়ে দরজা খুললাম। ভাবী দাঁড়িয়ে আছে। “আজ দেখা নাই তোমার, খোজ নিতে আসলাম।” বলল সে।
“এই শীতের মধ্যে কই আর যাব। আপনি ভেতরে আসেন।”
“আমি পড়ার জন্যই আসলাম।”
“ও আচ্ছা।” খেয়াল করলাম তার হাতে কোন বই নেই। “বই খাতা কোথায়?”
ভাবি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। আমি হেসে ফেললাম, “আচ্ছা আজ পড়ার দরকার নাই। আসেন গল্প করি।”

দুজনে ঘরে বসলাম। এই গল্প সেই গল্প। আমি আমার লাইফের কথা বললাম, যতটা সম্ভব। ভাবী একটু চাপাচাপি করল। আমি নিরুপায় হয়ে বানিয়ে বানিয়েই খানিকটা শুনিয়ে দিলাম।
এরপর ভাবী বলল, “তোমার খাওয়ার ব্যবস্থা কি?”
“এখনও তো রান্না করি নাই।”
“খাবা কি?”
“দেখি কি খাওয়া যায়?”
“চলো, তোমাকে রান্না করে দেই।”

আমি একটু ভদ্রতা করে মানা করলাম, কিন্তু ভাবী আমাকে টেনে ওঠাল। দুজন মিলে রান্নাবান্না সারলাম। সামাদ ভাইয়ের জন্য নিয়ে যান, বললাম। কিন্তু ভাবী মানা করে দিল। তাদের বাসায় রান্না করা আছে। জোরাজুরি করাতে বলল, “তোমার ভাই জানে না যে আমি তোমার সাথে এত টাইম কাটাই। মাইন্ড করতে পারে।”

আমি ভ্রূ কোঁচকালাম। কিন্তু কিছু বললাম না। দুজনে দুপুরের খাওয়া একসাথেই সারলাম। তারপর ভাবী বিকেলের দিকে চলে গেল।
পরের দিনের কথা। তখন এখনকার মত স্মার্ট টিভি বা স্মার্টফোনের চল ছিল না৷ খুব অল্প লোকের হাতেই স্মার্টফোন আছে তখন। বাসার ডিশের লাইনে খানিকটা সমস্যা হয়েছে হয়ত। ঝিরঝির করছে টিভি। আমাদের কেবলের কানেকশনের অ্যাডাপ্টারটা পাশের বাসার ছাদে।

বাসার পেছনে একটা গাছ আছে। সেটা বেয়ে ওদের একতলার ছাদে উঠে ঠিক করা যায়। আমি বের হয়ে গেলাম। গাছটা ঠিক আমাদের বাসার নিচতলার বাথরুম বরাবর। আমি বেয়ে অনেকটা উঠতেই বাথরুমের ভেন্টিলেটরের জানালায় চোখ পড়ল। ভেতরে আলো জ্বলছে৷ আমি শিউরে উঠলাম। শিউলি ভাবী!

ভেতরের অনেকটাই দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। নগ্ন হয়ে সাবান মাখছে গায়ে। অসাধারণ সুন্দর তার শরীরটা। ভরাট স্তন, ভারী নিতম্ব, সাবান গায়ে ঘষার সময়ে ঝাকি লেগে কেপে উঠছে স্তনজোড়া। আমি হা করে তাকিয়ে আছি। জমে গেছি যেন। না পারছি উঠতে না পারছি নামতে।

গভীর নাভীতে লেগে আছে সাবানের ফেনা। তার নিচে দুই পায়ের ফাকে যোনির ওপর বেশ ঘণ চুল। বেশ কিছুদিন ধরে কাটে না হয়ত। কলাগাছের মত মসৃণ ফোলা ফোলা মাংসল উরু। হঠাৎ করেই ভাবী তার তীক্ষ্ণ ধূসর চোখজোড়া মেলে তাকাল আমার দিকে।
অদ্ভুত ব্যাপার! আমি ভেবেছিলাম ভাবী এখনই চিৎকার দিবে। নিজেকে ঢাকার চেষ্টা করবে। বা জানালা বন্ধ করে দেবে।
ভাবী তার কোনটাই করল না। তাকিয়েই রইল আমার দিকে। আমি তখনও গাছের ডাল ধরে বান্দরের মত ঝুলছি।

সম্বিৎ ফিরে আমি নেমে গেলাম গাছ থেকে। তারপর বাসায় চলে গেলাম। বাকি পুরো দিনটা কাটল দুশ্চিন্তায়। ভাবী কি ভেবেছে কে জানে? কাউকে বলে দিলে সর্বনাশ৷ মান ইজ্জত বলে কিছু থাকবে না আর। ভাল একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। সেটা নষ্ট হয়ে গেল।

আমি ভয়ে টেনশনে অস্থির হয়ে গেলাম। পরের দিন সকালে আবার গেলাম সেই শিউলি গাছের কাছে। অনেকগুলো ফুল নিয়ে এলাম। বাসায় এসে কিছু চকলেট সেই ফুল আর একটা কাগজে লিখলাম, ভাবী আমি খুবই দুঃখিত, ব্যাপারটা অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়েছে। আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।

একটা ছোট বাক্সে সব কিছু রেখে ছাদে যেখানে ভাবী পড়তে বসে সেখানে রেখে এলাম।

সঙ্গে থাকুন …