আমার দাদাবাড়ী আর নানা বাড়ী ছিল পাশাপাশি গ্রামে। তবুও আমরা ছোট বেলা থেকে নানুবাড়ী যেতে পারিনা। মামাদের সাথে আম্মার সম্পর্ক ভাল ছিলনা কেননা আম্মা ছোট বেলাই নানা নানী দুজন কে হারান। আম্মা বড় হয় মামাদের কাছে, আমার তিন মামার মধ্য শুধু ছোট মামা দেশে আছেন এবং বাকী দুই মামা সৌদি আরবে পরিবার সহ চলে গেছেন প্রায় ত্রিশ বছর আগে। এরা এখন অবধি দেশে আসে নাই। তারাও কখনো আম্মার খোঁজ খবর নে নাই। ছোট মামার সাথে আম্মার সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কারন হল নানা মারা যাওয়ার পূর্বে আম্মাকে বেশ কিছু সম্পত্তি দিয়ে যান।
দুই মামা তাদের সব সম্পত্তি বেঁচে দিয়ে চলে গেছে তাই সম্পত্তি ছিল শুধু আম্মা আর ছোট মামার। যেহেতু ছোট মামা আম্মাকে বড় করেছেন এবং তিনি বিয়ে দিয়েছেন তাই আম্মার প্রাপ্ত ভাগ তিনি নিজের নামে করে ফেলেছেন। আম্মা যেহেতু ছোট ছিল তাই মামা এই কাজ টা করে ফেলেন। পরবর্তীতে অবশ্য কখনো আম্মাকে আমরা দেখি নাই সম্পত্তির জন্য কোন রকম ঝগড়া বিবাধ করতে। আম্মার আসলে সম্পত্তির জন্য কোন চাওয়া ছিল না। কিন্তুু আম্মার কষ্ট শুধু এই কারনে যে আম্মাকে তার ভাই রা কখনো দেখতে আসা বা কোন খোঁজ খবর নিত না তা নিয়ে। বড় মামা নাকি বিদেশে মারা গেছে, সেই খবর টাও আম্মা জানতে পারে অনেক দিন পরে।
আর এদিকে দাদাবাড়ী ছেড়ে আমরা চলে আসি অনেক বছর আগে। অবশ্য গ্রামে আমাদের জমিজমা সব আছে। আব্বা রা ছিলেন দুই ভাই আর দুই বোন। আমার দাদা গ্রামে প্রভাবশালী মানুষ ছিলেন। তার দানকৃত জায়গাতে মসজিদ, মাদ্রাসা হয়েছে। দাদা কে গ্রামে হাজী সাহেব বলে ডাকতো, এই গ্রামে তিনিই প্রথম বিমানে করে হজ্বে গিয়েছিলেন। গ্রামের চেয়ারম্যান অবধি দাদার সামনে কথা বলতে পারতোনা। আমার বাবা চাচা ফুফি সবাই কে তিনি শিক্ষিত করেছেন।
আমার বড় ফুফি মারা গেছেন, আর চাচার সাথে আব্বার তীব্র বিরোধ। বিরোধের কারন সেই সম্পত্তি। চাচার সাথে মনমালিন্য হওয়াই আব্বা একেবারে গ্রাম ছেড়ে চলে আসেন। তবে গ্রামে যে একদম যাওয়া হয়না তা কিন্তুু নয়। বছর তিনেক আগে আমাদের পরিবারের সবাই গ্রামে গিয়েছিলাম চাচাত ভাই এর বিয়ে উপলক্ষ্যে। কিন্তুু সমস্যা টা যখন আব্বা আর চাচার মধ্যে তখন তো আর এত সহজে সমাধান হয় না।
আমাদের পরিবারে শুধু ছোট ফুফির সাথে একমাত্র ভাল সম্পর্ক আছে। কারন ফুফিরাও শহরে থাকে।
আমাদের পরিবার নিয়ে এত কথা কেন বললাম তা পরে বুঝতে পারবেন। আর হ্যাঁ এটা গল্প মনে করতেও পারেন। আবার সত্য কাহিনীও মনে করতে পারেন। কেননা আমি যা লিখছি অনেক টা বাস্তব এবং সত্য ঘটনাই লিখছি। কাহিনী টা সত্য নাকি মিথ্যা তা আপনারা পড়লে বুঝতে পারবেন আশা করি।
আমরা শহরে চলে আসি প্রায় ১৫ বছর আগে। আব্বা একটি ব্যাংকে চাকরী করতেন। তারপর থেকে সব কিছুই আমাদের এখানে। আমি দাখিল পাস করে কলেজে ভর্তি হই। এরপর কলেজ থেকে ভাল রেজাল্ট করি। কলেজে পড়ার সময় আসলে একরকম একটা সমস্যাই ভুগি তা হল কলেজে মাদ্রাসার ছাত্রদের অনেকটা হেলা করে সবাই। স্কুলের ছাত্র রা মনে করে মাদ্রাসার পরীক্ষা অনেক সোজা। মাদ্রাসা বোর্ড যাকে তাকে নাম্বার দিয়ে দে। তাদের ধারনা আমরা যারা মাদ্রাসাই পড়ি তারা স্কুলের ছেলেদের সাথে পড়ালেখাই পারবোনা। মাদ্রাসার ছেলেরা বলদ টাইপের হয়। এমন সব ধারনা পোষন করে অনেক ছাত্র এবং শিক্ষক রাও। যারা মাদ্রাসা হতে কলেজে গিয়েছে তারা হয়তো আমার কথা গুলোর সাথে একমত হতে পারবে। আসলে সত্যি টা হল মাদ্রাসার ছেলেরা তুলনামূলক ভাবে এগিয়ে থাকে। তার কারন হল মাদ্রাসার ছেলেদের মধ্যে একটা সময় মেনে চলার নিয়ম থাকে। একজন মাদ্রাসার ছেলের জন্য ফজরের সময় ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসা কোন ব্যাপার না। এবং মাদ্রাসার ছেলেরা অনেক কিছু এড়িয়ে চলে সুপথে থাকার চেষ্টা করে।
আমি যে কলেজে পড়তাম তখন ভাল বন্ধু বলতে তেমন কেউরে পায়নি। আমিও তেমন বন্ধু পাগল ছেলে নই। যার কারনে আমি আমার মত পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পারতাম। তো এরপর ভাল রেজাল্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। আমি যে ভার্সিটি তে পড়েছিলাম সেটি তখন নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয়। অবশ্য ভার্সিটিতে এসে বেশ ভাল কজন বন্ধু পেয়েছি।
ভার্সিটি থেকে আমার বাসার দূরত্ব বলতে গেলে তেমন বেশী না। বাসে করে বড়জোড় দেড় দুই ঘন্টার রাস্তা। কিন্তুু আমি বছরে দু এক বারের বেশী বাসাই যায় না। কেননা টিউশন ফেলে কোথাও যাওয়ার সেই সুযোগ টা নেই। আমি অবশ্য টিউশন করে ভাল টাকা ইনকাম করেছি সেই সময় টাতে। আমি ভার্সিটি ভর্তি হওয়ার কয়েক মাস পর থেকে আর ঘর থেকে আর টাকা পাঠাতে হয়নি। আমার সব খরচ আমার ইনকাম দিয়ে হয়ে যেত এবং আরো টাকা সঞ্চয় করেছি।
এবার মূল কাহিনী টা শুরু করি। সময় টা ২০১২ সালের দিকে হবে। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আমার নাম টা বলা হয়নি, আমি ফয়সাল। আমার পরিবারে সদস্য সংখ্যা চারজন। আব্বা,আম্মা আর আমার ছোট বোন ফারজানা। ফারজানা এবার দাখিল(এসএসসি) পাস করে মহিলা মাদ্রাসাই ভর্তি হয়েছে। আম্মা চেয়েছিল ফারজানা কেও আমার মত কলেজে ভর্তি করাতে। কিন্তুু আব্বার কথা ফারজানা কে মাদ্রাসাতেই পড়াবে। আব্বার মতামত হল তার মেয়ে কলেজে গেলে অন্য ছেলেমেয়ে দের সাথে মিশে উঠতে পারবেনা। কলেজে মেয়েদের জন্য তেমন সুবিধা নেই। এবং কলেজে ছেলেরা নাকি অভদ্র হয়। তাই ফারজানা কে মাদ্রাসা তে ভর্তি করা হল। আসলে আমিও মনে করি ফারজানা কলেজে ছেলেমেয়ে দের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারবেনা, কারন ফারজানা অন্য দশজন মেয়ের মত অত চালাক চতুর নয়। সে অসম্ভব শান্ত এবং একদম চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। তাই তার জন্য মাদ্রাসাই ভাল।
সেইবার ঈদে আমি বাসাই গেলাম যথারীতি অনেক দিন পরে। ২০ রোজাতে আমি বাসাই গিয়ে পৌঁছাই অনেক টা আম্মার অনুরোধে। বাসাই গিয়ে দেখি আব্বার হার্টের সমস্যা টা আবার বেড়ে গেছে।
পাঁচ মাস আগে আব্বা আম্মা ইন্ডিয়া থেকে চিকিৎসা করে এসেছে। তখন ডাক্তার বলেছিল তিন মাস পর আবার গিয়ে চেক আপ করিয়ে আসতে। কিন্তুু আব্বার দাবী তিনি সুস্থ হয়ে গেছেন। তার আর ইন্ডিয়া যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তুু হঠাৎ করে রোজার সপ্তাহ খানেক পর থেকে নাকি হার্টের সমস্যা টা অনেক বেড়ে গেছে। এবং তিনি কথা টা আম্মাকেও বলেন নি।
অতএব আবারো আমি সব কিছু তাড়াতাড়ি ম্যানেজ করা শুরু করে আব্বাকে ইন্ডিয়া পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম। এবার আম্মা আব্বার সাথে ফুফা ফুফি দুজনই নাকি ডাক্তার দেখাতে যেতে চাচ্ছে। ফুফির শ্বাস কষ্টের সমস্যা, তিনিও যাবেন। তাদের দুজনের ডকুমেন্টস সব জোগাড় করে সব কিছু ম্যানেজ করলাম। কেননা দুদিন পরেই সব ঈদের ছুটিতে বন্ধ হয়ে যাবে।
সব কিছু রেডি করার পর আব্বাদের যাওয়ার তারিখ ফিক্সড হল ঈদের পাঁচদিন পরে। অর্থাৎ ঈদের ছয় তম দিনে আব্বারা ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্য রওনা দিবেন।
এতদিন ধরে বিভিন্ন কাজের চাপে আমি কোন ধরনের ঈদের কেনাকাটা করতে পারিনি। বলতে গেলে সময় এবং ইচ্ছে কোনটাই হয়ে উঠেনি। চাঁদ রাতের দিন ফারজানা দেখি আমার রুমে এসে একটা প্যাকেট দিয়ে বললো ভাইয়া এটা পরে দেখো। আমি ফারজানা কে জিজ্ঞাসা করলাম এটা কি? ফারজানা উত্তর দিল আম্মা আর সে নাকি মার্কেটে গেছিল। তখন আমার জন্য পাঞ্জাবী টা কিনছে। আমি বের করে দেখি একটা সাদা পাঞ্জাবী। পাঞ্জাবী টা রেখে দিতে চাইলে ফারজানা এক প্রকার পরতে বাধ্য করলো। পাঞ্জাবী টা নাকি সে চয়েস করেছে। আমি পরে তাকে দেখালাম তার কথা পাঞ্জাবীটা আমাকে ভাল মানিয়েছে।পাঞ্জাবী টা আমারো পছন্দ হয়ছে, বলতেই হয় ফারজানার চয়েস আছে।
তারপর ঈদের নামাজ পড়ে বাসাই এসে খাওয়া দাওয়া করে আমি গেলাম ফুফুদের বাড়ীতে। ফুফুদের সব ডকুমেন্টস বুঝিয়ে দিয়ে পরদিন চলে আসলাম। বাসাই ফিরে দেখি ফারজানার এক বান্ধবী বেড়াতে এসেছে। একটু পরে দেখি সে ফারজানা কে তাদের বাসাই নিয়ে যাওয়ার জন্য আম্মাকে অনুরোধ করছে।
কিন্তুু আম্মা কোন ভাবেই ফারজানা কে যেতে দিবেনা। তার বান্ধবী দেখি খুব জোড়াজুড়ি করে আম্মাকে রাজী করিয়েছে। আম্মা বলেছে ফারজানা কে তাড়াতাড়ি চলে আসতে।