সকাল প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ রক্তিম তাঁর পেশাদারী কালো সুটটি পরে ফ্ল্যাটের দরজায় চাবি দিয়ে বেরিয়ে আসে। সঙ্গে হাতে তাঁর একটি জামাকাপড়ের লাগেজ ব্যাগ ও একটি কালো সুটকেস। ব্যাগ হাতে চার তলা সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমেই সে দেখে তাঁর অফিসের কালো গাড়িটি ইতিমধ্যে ফ্ল্যাটের মুখ্য দ্বারে এসে অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য। তাই সে আর সময় নষ্ট না করে ফ্ল্যাটের ওয়াচম্যানের সাথে একবার দেখা করে গিয়ে বসে গাড়ির ভেতরে। তারপর গাড়ির দরজা বদ্ধ করে ড্রাইভারকে সবুজ সংকেত দিয়ে পকেট থেকে বের আনে এক জোড়া হেডফোন এবং একে একে করে গুজে দেয় নিজের দুই কানে। এরপর গাড়িটি চলতে শুরু করলে রক্তিম তাঁর মোবাইলে পছন্দের প্লেলিস্টটি চালু করে এবং ফোনটি পুনরায় জামার বুক পকেটে চালান করে পিঠটি এলিয়ে দেয় গাড়ির পেছনের সিটটাতে। এরপর হিন্দি ও ইংরেজি মিশ্রিত গান শুনতে শুনতে কখন যে তাঁর চোখটি লেগে আসে তা আর খেয়াল থাকে না রক্তিমের। তবে বেশ কিছুক্ষণ পর তাঁর তন্দ্রা কাটে ড্রাইভারের হাঁক-ডাকে,
-“স্যার, হাম পহোছ গেয়।”
চোখ মেলে রক্তিম দেখে তাঁর ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে তাঁর দিকে হুমড়ি খেয়ে তাকিয়ে আছে। এদিকে মোবাইলে প্লেলিস্টের সমস্ত গান শেষ হয়ে কানের হেডফোনটি এখন কানের কাছে নীরবতা পালন করছে। সুতরাং কান থেকে সেটি খুলে মোবাইল সহ হেডফোনটিকে প্যান্টের পকেটে পূরে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে রক্তিম। এরপর গাড়ির পেছনের গিয়ে ডিঁকি থেকে জামাকাপড়ের বড় লাগেজ ব্যাগটি বের করতেই রাস্তার বড় ঘড়িটি বারবার ‘ঢং’ ‘ঢং’ শব্দে তাঁকে জানিয়ে দেয় বর্তমান সময়। “একদম সঠিক সময়ে এসে পরেছে সে”- মনে মনে এটি ভেবে নিয়ে বেশ খুশি হয় রক্তিম। তারপর বাম হাতে সুটকেসটি ধরে এবং ওপর হাতে লাগেজ ব্যাগটি টানতে টানতে সে প্রবেশ করে বিমানবন্দরের ভেতরে।
ঝাচকচকে এয়ারপোর্টের ভেতরে ঢুকে রক্তিম লক্ষ্য করে ভেতরটা যেন আর বাকি দিনের চেয়ে আজ একটু বেশী ভিড়। “সব আহেলির জাদু” মনে মনে এটা ভেবে নিয়ে সামান্য মুচকি হাসে রক্তিম। তারপর রিসেপ্সনের কাউন্টারের লম্বা লাইন উপেক্ষা করে কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিতেই ভেতরের লোকজন প্রায় বিনা বাক্যব্যায়ে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দেয় দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি লোকের দিকে। নিল সুট পরিহিত সেই লোকটি এতক্ষণ তাঁর দু’হাত বুকের কাছে ধরে এয়ারপোর্টে রানওয়ের দিকে তাকিয়ে প্লেনের ওঠা নামা দেখছিল; তবে রক্তিমের কাছে যেতেই সে তাঁর দিকে ঘুরে তাকায়। এরপর চশমা আড়াল থেকে খুঁতখুঁতে চোখ দিয়ে রক্তিমের আপাত মস্তক একবার জরিপ করে নিয়ে খেসখেসে স্বরে সেই বয়স্ক লোকটি বলে ওঠে- “আপনিই তাহলে রক্তিম?” লোকটির মুখে বাংলা শুনে কিছুটা বিস্মিত হয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায় রক্তিম।
-“তা বেশ, বেশ। চিন্তা নেই, আমিও বাঙ্গালী। তো আপনার আইডি?”
পকেট থেকে নিজের আইডি কার্ড ও সুটকেস থেকে প্রয়োজনীয় কিছু কাগজ বের করে রক্তিম বাড়িয়ে দেয় সেই লোকটির দিকে। লোকটি তাঁর পেছনের চেয়ারটিতে বসে চশমার নিচ দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেগুলিকে পর্যবেক্ষণ করার সাথে বলতে থাকে –“তো, এই পেশায় তো নতুন দেখছি। আগে যদিওবা পুলিশের চাকরি করতেন, যার দৌলতেই হয়তো আপনাকে এই কাজটি দিয়েছে। তবে…(একটা দীর্ঘ বিরতি নিয়ে) মালের পেছনে ছোটা ও মালকে পাহারা দেওয়া দুটো আলাদা বিষয়; জানেন তো নিশ্চয়ই?”
লোকটির মুখে অকস্মাৎ এমন একটি বিবৃতি শুনে এবার কিছুটা অবাক হয় রক্তিম। তাঁর চোখে-মুখেও বোধয় সেই বিস্ময় ভাবটাই ফুটে উঠেছিল, যা দেখেই বোধয় লোকটি এবার স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে তাঁর হাতে থাকা কাগজপত্রগুলিকে আবার রক্তিমের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
-“এই নাও। আমার কাজ শেষ। এখন এখানেই অপেক্ষা কর যতক্ষণ না ম্যাডাম এসে পৌঁছচ্ছে।”
-“তবে রিসেপ্সনে আমি তো শুনলাম প্যারিসে ফ্লাইটটি আর কুড়ি মিনিটের মধ্যেই ছেড়ে দেবে?” আচমকা প্রশ্নটি করে নিজেই যেন কিছুটা বোকা হয়ে যায় রক্তিম। ওদিকে লোকটি ততক্ষন সেখান থেকে যাওয়ার উপক্রম করছিল; তবে রক্তিমের মুখে আচমকা এমন প্রশ্ন শুনে সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর রক্তিমের মুখ বরাবর কিছুক্ষণ লোকটি হা করে চেয়ে নিয়ে সহসা হোহো করে অট্টহাসি দিয়ে বলে ওঠে, -“শোন কথা, তোমার কি মনে হয়? এতো বড় তারকা যার বাবা কিনা এ দেশের টপ বিজনেসম্যানদের মধ্যে একজন। তাঁর মেয়ে কিনা যাবে ফ্লাইটে সাধারণ মানুষদের সাথে চেপে!!!”
এতটুকু বলেই লোকটি তাঁর আঙ্গুল উঁচিয়ে রক্তিমকে দূরে ইশারা করে বলে ওঠে- “ওই দিকে দেখো।” রক্তিম তাঁর আঙ্গুল বরাবর সে দিকে তাকাতেই দেখে দূরে সেখানে একটি এরোপ্লেন দাঁড়িয়ে আছে। আকারে সেটি আর বাকি বিমানগুলির তুলনায় কিছুটা ছোট; বোধয় প্রাইভেট প্লেন হবে। তবে প্রাইভেট হলেও এক চেটিয়া সাদা বিমানগুলির মাঝে সেটি যেন বেশ রাজকিও ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। একবার তাকালে যেন সূর্যের আলোয় ঝলমল করতে থাকা সেই নতুন বিমানটির থেকে চোখ সরানো দায় হয়ে উঠবে যে কোন সাধারণ মানুষের পক্ষে।
বিমানটির দিকে তাকিয়ে রক্তিমের দু’চোখ আটকে গিয়েছে এমন সময়ে লোকটি তাঁর পাশ থেকে বলে ওঠে –“ওটা হচ্ছে মিস সান্যালের পার্সোনাল প্লেন। আগের বছরই ওর বাবা ওকে আঠারোতম জন্মদিনের উপহার হিসেবে ওটা দিয়েছে। কেন খবরে তো দেখানো হয়েছিল! খবর-টবর দেখো না হে?” এই বলে সামান্য নিস্তব্ধ থেকে লোকটি আরও বলে ওঠে –“যাই হোক, আমি আসি তাহলে।”
-“হ্যাঁ…” অস্ফুট স্বরে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়েই বলে ওঠে রক্তিমের। তাঁর মনোযোগ এখনও সেই প্লেনটির দিকেই নিবদ্ধ। ধনী ব্যক্তিরা যে নিজেদের চলাফেরার জন্য দামী গাড়ির পাশাপাশি পার্সোনাল প্লেনও রাখে তা সে আগের থেকেই জানত। তবে আজ এমনি একটি ভি.আই.পি. যাত্রীর পার্সোনাল প্লেন সামনের থেকে দেখে চোখ যেন সরতে চাইছে না তাঁর। তাঁর মনে পড়ে যায় দু-এক মাস আগে নিউজ চ্যানেলে দেখানো এই বিমানটির সংক্রান্ত খবর। তবে শুধু নিউজ চ্যানেল না বরং নিজের অফিসিয়াল সোশ্যাল মিডিয়ার পেজেও আহেলি সেদিন টিভি এঙ্কার সেজে মাইক হাতে নিজের বিমান প্রদর্শন করিয়ে ছিল সকল দর্শককে। সেই বিমানের ভেতরে আরাম করার জন্য বেশ কয়েকটি কক্ষ এবং তাঁদের প্রায় সব কয়েকটি ইন্টারনেট পরিষেবা যুক্ত। এছাড়াও একটি ডাইনিং রুম সহ তাঁতে রয়েছে আরও বেশ কয়েকটি অঞ্চল যেখানে জাবটিও চিন্তা ভাবনা ছেড়ে আরামে সারাটা দিন অতিবাহিত করা যাবে যে কোন লোকের পক্ষে। তবে টিভিতে দেখা প্লেন যদি সামনে থেকে দেখে এতটা সুন্দর লাগে তবে তাঁর ভেতরে যাত্রা করা মেয়েটি সামনের থেকে আরও কতটা সুন্দর দেখাবে, এই ভাবনা মাথায় আসতেই আহেলির সুন্দর রূপটি ভেসে ওঠে তাঁর সামনে। এবং এরই সাথে তাঁর মনে পড়ে যায় দেড় বছর আগে সে রাতের কথা।
সে বছর এ দেশের প্রখ্যাত বিজনেসম্যান মিস্টার অনিরুদ্ধ সান্যালের বড় মেয়ে মিস অহনা সান্যালের বিবাহ হয়েছিল। সে যদিওবা এক এলাহি ব্যাপার ছিল, দুর্গা পূজোর ন্যায়ে প্রায় চারদিন ব্যাপি ঘটা বিবাহের পর্বগুলি সুট করেছিল এ দেশের সমস্ত নিউজ চ্যানেল। এমনিতে ছাব্বিশ বছর বয়সী মিস অহনা সান্যাল দেখতে কোন বলিউডের নায়িকাদের চেয়ে কম যায় না। তাঁর ওপর বিবাহের রাত্রে যে ভাবে লাল সাড়ি পড়ে ও সোনায় মুড়ে সে বিবাহের মণ্ডপে প্রবেশ করেছিল তাঁতে যেন খানিকক্ষণের জন্য প্রায় সকল দর্শকদের নজর কেড়ে নিয়েছিল নিজের ওপরে।
তবে খানিকক্ষণের জন্য বলার কারণ বিবাহ চলাকালীন কোন এক সহৃদয় ক্যামেরা ম্যানের দৌলতে টিভির স্ক্রিনে আচমকাই ফুটে উঠেছিল একটি অপরূপ দেখতে কিশোরী মেয়ের প্রতিচ্ছবি। সম্ভ্রান্ত সান্যালদের পরিবারের মাঝে দামী ঘাগরা ও চোলির পোষাক পরিহিত সেই মেয়েটি যেন সেই এক মিনিটের ঝলকেই নিজের রুপের জৌলুসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল সমস্ত পুরুষের বুকের ভেতরে। সেই রুপের দংশনে অবশ্য বাদ থাকে নি রক্তিমও। এরই সাথে এক লহমায় রক্তিমের মত টিভির দিয়ে চেয়ে থাকা সকল গরম রক্তের পুরুষদের মনে সে রাত্রে মূল আকর্ষণ ও কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেই মেয়েটি। এর সঙ্গে বিবাহরত সুন্দরী অহনার বিবাহে শোকাহত তাঁর পাগল প্রেমিক ভক্তরা নিজেদের বাঁচার জন্য নতুন রসদ হিসেবে খুঁজে নিয়েছিল সেই মেয়েটিকে।
এরপর কৌতূহল মেটাতে সেই মেয়েটির বিষয়ে ইন্টারনেট ঘেঁটে রক্তিম পরে জানতে পারে যে সেই সুন্দরী মেয়েটি আসলে কেও না বরং মিস্টার অনিরুদ্ধ সান্যালের ছোট মেয়ে আহেলি সান্যাল। আহেলি সান্যালের সক্রিয়তা যদিওবা ইন্টার কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় এর আগে তেমন ছিল না; থাকলে অবশ্য শোরগোল পরতে বেশী সময় লাগত না। তবে তক্ষণ না পড়লে কি হয়েছে, সে রাত্রের পর থেকে আহেলির নাম ও রুপের চর্চা বনের দাবানলের মত ছরিয়ে পরেছিল ইন্টারনেট জগতে। এক রাতের মধ্যেই ইন্টারনেট জগতে আচমকা সৃষ্টি হওয়া ভক্তদের জন জোয়ার দেখে এরপর একদিন আহেলির বাধ্য হয় নিজে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার একটিভ হতে। এরই সঙ্গে তৈরি হয় আহেলির নিজস্ব অফিশিয়াল ফ্যান পেজ এবং তাঁতে আপলোড হতে থাকে তাঁর বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও।
এরপর একদিন তাঁর একটি ব্লগে আর সকলের মতন রক্তিম জানতে পারে যে সে নাকি অতি সিগ্রই সিনেমার জগতে আসতে চলেছে। তবে তাঁর যা রূপ তাঁতে সিনেমার জগতে আসলে আর বাকি তথাকথিত নায়িকাদের অবস্থা যে বেশ করুন হয়ে উঠতে চলেছে তা আর বুঝতে বাকি থাকে না রক্তিমের। এদিকে ততদিনে আহেলি তাঁর রুপের মায়ায় যে আর বাকি ছেলেদের মতন রক্তিমের মনকেও গ্রাস করে নিতে সমর্থ হয়ে পরেছিল তা আর বলার অবকাশ রাখে না। কারণ সে দিনের পর জীবনে প্রথমবার রক্তিম বাধ্য হয়েছিল নিজের থেকে কোন সেলিবেটির ফ্যান পেজে গিয়ে তাঁকে ফলো করতে। এবং এরপর তাঁর মোহে বশবর্তী হয়ে রক্তিমের ফোন ও ল্যাপটপের গ্যালারি জুড়ে জায়গা করে নিতে থাকে আহেলির বিভিন্ন নতুন নতুন ছবি ও ভিডিও।
পুরনো দিনের কথা ভাবতে ভাবতে রক্তিমের এবার আচমকা খেয়াল হয় সেই লোকটির কথা। মাথা ঘুরিয়ে রক্তিম দেখে লোকটি নেই। লোকটি যে বড্ড বাচাল ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। সাধারণত সিকুরিটি ইন্সপেক্টরের পেশায় এমন বাচালতা শোভা পায় না। বোধয় ভিন ভাষী এই শহরে নিজের মতন একজন বাঙ্গালী খুঁজে পেয়েই তাঁর ভেতরকার বাঁচাল সত্তা উঁকি মেরেছিল উঠেছিল এক মুহূর্তের জন্য। তবে রক্তিমের চিন্তার কারণ সেটা নয় বরং তাঁর প্রিয়সির উদ্দেশ্যে বলা লোকটির একটি সম্বোধনে। একজন সাধারণ সিকুরিটি ইন্সপেক্টরের মুখে তাঁর ম্যাডামের উদ্দেশ্যে বলা মাল শব্দটি যেন বেশ কানে লেগেছিল তাঁর। ‘যা্! লোকটির নাম শোনা হল না!’ এটি খেয়াল হতেই বেশ আপ্সস হয় রক্তিমের। নাম জানলে হয়তো কোন ব্যবস্থা নিলেও নেওয়া যেতে পারত। চেয়ারে বসে আপ্সসের ভঙ্গীতে সামনের দিকে তাকিয়ে অন্য কিছু ভাবতে যাচ্ছে এমন সময়ে আচমকা যেন তাঁর কানের পাশ থেকে একটি চেনা কিন্তু অপ্রত্যাশিত মিষ্টি কন্ঠস্বর বলে উঠে-
-“হ্যালো! মিস্টার।”
[কে ডাকল রক্তিমকে? তবে কি রক্তিমের এতদিনের প্রতিক্ষার অবসান ঘটল? নাকি অন্যকিছু, জানতে হলে চোখ রাখুন এই সিরিজের পরের পর্বটিতে]
চলবে…
লেখিকা- স্নেহা মুখার্জি